মাশরুফ হোসেন

পরিবারের এক সদস্যকে নিয়ে গত সপ্তাহে হঠাৎ ইমার্জেন্সিতে গিয়েছিলাম। ঠিক পাশের বেডে তখন মঞ্চস্থ হচ্ছে আরেক নাটক। বাহাত্তর বছর বয়েসী এক ভদ্রলোক সেখানে ভর্তি, বাইরে উৎকণ্ঠিত আত্মীয়-স্বজন। সম্ভবত ভদ্রলোকের মেয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে, নীল পোশাকের অত্যন্ত সুদর্শন এক তরুণ পায়চারি করছে। আমি আত্মীয়কে নিয়ে ভেতরে গেলাম, দেখলাম পাশের বিছানাতে তারা সবাই জড়ো হয়েছে। মেয়ে তার বাবার হাত ধরলো, তারপর ডুকরে কেঁদে উঠলো। আর যারা বাইরে বসে ছিলেন, সুদর্শন ওই তরুণ বাইরে গিয়ে একবার মাত্র মাথা এপাশ-ওপাশ নাড়লেন। এর মানে একটাই, সব শেষ। শুরু হলো কান্নার রোল। পনের মিনিটের মাথায় ডেথ সার্টিফিকেট এলো, যে মানুষটার নাম ছিলো, পরিচয় ছিলো, তাকে সম্বোধন করা হলো এভাবেÑ ‘বডিটা নিয়ে যান’। আরো পনের মিনিট পর এ্যাম্বুলেন্সে করে মানুষটিকে নিয়ে যাওয়া হলো তার গ্রামের বাড়ির গন্তব্যে, সিলেটের গোলাপগঞ্জের দিকে। আমি ওই তরুণকে পরিচয় দিয়ে বললাম, ভাই, কিছু লাগলে জানাবেন। পরের দিন কল করে জেনেছি, দাফন সম্পন্ন হয়েছে। রাত প্রায় দুটো বেজেছিলো বাসায় আসতে আসতে। 

এই সময়ে খেয়াল করলাম, কী একটা ইস্যুতে ওখানে যারা ডাক্তার, স্টাফ ছিলেন সবাই হো হো করে একসঙ্গে হেসে উঠলেন। প্রথম ধাক্কায় প্রচণ্ড রাগ হলো, এই মাত্র একজন মারা গিয়েছেন, এর মধ্যেই এভাবে উচ্চস্বরে সম্মিলিত হাসি? বাসায় স্ত্রী বললো, দেখো, এই মানুষগুলোর কাছে এটা রুটিন জব। তুমি একটা অপারেশন শেষে প্রচণ্ড স্ট্রেস রিলিফ করতে কলিগদের সঙ্গে হেসে ওঠো না? এটাও তাই। এটা না করলে এই মানুষগুলো ফাংশনই করতে পারবে না। ডেথ ইজ বিজনেস এ্যাজ ইউজুয়াল, এর কোনো আলাদা বিশেষত্ব নেই। এটা মেনে নিতে শেখো, বুঝতে শেখো। ওই মুহূর্তে ওখানে বসে আমার মনে হয়েছে, এই যে ঘর সংসার চাকরি-বাকরি ইঁদুর দৌড়। এইগুলা সবই মোহ মায়া, পদ্ম পাতার উপরে টলটলে এক ফোঁটা পানি মাত্র, পাতাটা সামান্য মৃদু হাওয়াতেই নড়ে উঠবে, সেই সাথে টুপ করে গড়িয়ে পড়বে জীবন বিন্দু। ক্ষমতা, খ্যাতি, অর্থ, জ্ঞান- এসবের পেছনে ছোটার জন্য যে হাহাকার, নান অফ দিজ শিট আর রিয়েল। 

মানব জীবনে একমাত্র এবং সবচাইতে বড় সত্য হচ্ছে, মৃত্যু। আমাদের জীবনে বাকি যা কিছু আছে সবই মিথ্যা, মৃত্যু নামক সবচেয়ে বড় সত্যটাকে ঢাকতে সম্মিলিতভাবে আমরা এই মিথ্যা জীবনযাপন করি। যেসবের জন্য পারলে জীবনটাই দিয়ে দিই, মৃত্যু নামক মহা-সত্যের সামনে তা তুচ্ছাতিতুচ্ছ কৌতুক মাত্র। এই শিক্ষাটুকু নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়া আমার দরকার ছিলো। এই লিখে রাখলাম, যদি আর কারও প্রয়োজন পড়ে। ফেসবুক থেকে